Hathazari Sangbad
হাটহাজারীসোমবার , ৮ এপ্রিল ২০২৪

ঈদে পুরুষের বাজেট কি আসলেই কম?

অনলাইন ডেস্ক
এপ্রিল ৮, ২০২৪ ৮:১৩ অপরাহ্ণ
Link Copied!

রমজান মাস শেষের দিকে। ক’দিন পরই ঈদ। ভিড় বেড়েছে শপিং মলগুলোতে। সবাই যে মলে যাচ্ছেন, তা নয়। সামর্থ্য অনুযায়ী নানা মানুষ নানা মার্কেট থেকে প্রিয়জনের ঈদ রাঙাতে কেনাকাটা করছেন। ভিড় আছে বাড়ি ফেরাতেও। সব মিলিয়ে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশ। আর এর মধ্যেই বিচিত্র বিষয় আসছে নাগরিক আলোচনায়। এই যেমন এখন উঠেছে ঈদের কেনাকাটায় নারীর বাজেট বেশি, নাকি পুরুষের–সেই বিষয়ক বিতর্ক।

একটি সংবাদমাধ্যমের করা ভিডিও প্রতিবেদন থেকেই মূলত এমন আলোচনার সূত্রপাত। আমাদের দেশের বেশির ভাগ সংবাদমাধ্যম এখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে কেন্দ্রে রেখে বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন বানায়। এসবের মধ্যে অনেকগুলো যে কেবলই ভিউ ধরার উদ্দেশেই বানানো, তা আর আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয় না। এমনই একটি কনটেন্ট হলো, ঈদের কেনাকাটার বাজেটে নারী-পুরুষের ভাগ নিয়ে করা প্রতিবেদনটি। এটি পুরোটা দেখলে, আপনার একসময় মনেই হবে যে, এ দেশের পুরুষেরা বড়ই অভাগা! গায়ের রক্ত জল করে তাঁরা অর্থ উপার্জন করছেন এবং পুরোটাই তুলে দিচ্ছেন ‘টাকাখেকো’ ও ‘খরুচে’ নারীদের হাতে।

উদ্ধৃতি চিহ্নের ভেতরে যে শব্দদুটি উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো বুঝেই লেখা হয়েছে। অন্তত ওই ভিডিওচিত্রটি দেখলে মনের ভেতর অবচেতনে নারীর খরুচে ও পুরুষের উপার্জিত অর্থের অযাচিত ব্যয়ে মূল ভূমিকা রাখার বিষয়টিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভিডিওচিত্রটি দেখার পর যেকোনো দর্শকের মনে হতেই পারে যে, এ দেশে পুরুষের জন্মই যেন শুধু আত্মত্যাগ করার জন্য। স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য উপার্জিত অর্থের যথেচ্ছ ব্যবহার করতে দিতে পুরুষেরা যেন বাধ্য। আর এভাবেই এ দেশের নাই কাজ তো খই ভাজ ঘরানার নেটিজেনদের বিতর্কের আরেকটি উপাদান দেওয়া হলো। তাতেই আরও নগ্নভাবে সামনে এল এ সমাজের চরম পুরুষতান্ত্রিক চরিত্রটি।

এখন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হরদম এমন ভিডিও শেয়ার হচ্ছে এবং কান না পাতলেও শোনা যাচ্ছে অগণিত পুরুষের দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ঘরের নারীর প্রতি বিদ্বেষের আগুনেও ঘি ঢালা হচ্ছে। কেউ কেউ আপত্তি তুলে বলতেই পারেন, এই মূল্যায়ন অতিরঞ্জিত! কিন্তু যদি একটি ক্ষেত্রে নারীদের পুরোপুরি নেতিবাচকভাবে দেখানো হয় এবং সকল ইতিবাচকতার আধার ও আত্মত্যাগের উৎস হিসেবে কেবলই পুরুষদের দেখানো হয়, তবে তাকে ঘৃণার চাষ না বললে আর কী বলা যেতে পারে? ধরুন, ওইসব ভিডিও দেখেই একজন স্বামী ঘরে গিয়ে নিজের স্ত্রীকে খরুচে হিসেবে সাব্যস্ত করল বা একজন ছেলে তার মাকে অমিতব্যয়ী হিসেবে অভিহিত করল, তখন কী হবে?

কী, এমনটা হবে না ভাবছেন? আপনি ভুল ভাবছেন। এমনিতেই আমাদের এই সমাজে নারীরা পুরুষদের তুলনায় পিছিয়ে আছে নানাভাবে, নানা ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যকার বৈষম্য এখনো অনেক। অথচ সেই বৈষম্য কমানোর বদলে নারীকে উল্টো খলচরিত্রে রূপায়িত করা হচ্ছে জেনেবুঝে। এ কারণেই পুরুষের ঈদের বাজেট কম বা নারীর চাকরি পুরুষ করলে অনেক পরিবার বেঁচে যেত ঘরানার আলাপ পাত্তা পায় দারুণভাবে। কারণ, যতই নারীর ক্ষমতায়ন ক্রমান্বয়ে বাড়ুক না কেন, এখনো এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে পুরুষের নিমিত্তে ভাবতেই ভালোবাসে।

আচ্ছা, নারীর ঈদ বাজেটই যদি এত বেশি হয় এবং পুরুষেরা আত্মত্যাগ করতেই থাকে কেবল, তবে এ দেশে পুরুষদের জামা–কাপড় বানানো প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো টিকে আছে কীভাবে? বেশির ভাগ ফ্যাশন হাউসই এখন নারী, শিশু ও পুরুষ–সবার জন্যই পণ্য বানিয়ে থাকে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে যে পণ্য কম বিক্রি হয় এবং বিক্রি কমতেই থাকে, সেগুলোর উৎপাদনই তো ক্রমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ হচ্ছে উল্টোটা। এবারের ঈদে জামা–কাপড়ের তুমুল ব্যবসা করা চারটি বড় বড় ব্র্যান্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ভিন্ন খবর। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই নারীর থ্রি-পিস ও পুরুষের পাঞ্জাবির বিক্রির পরিমাণ একেবারেই কাছাকাছি। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে পুরুষ ছাড়িয়েও যাচ্ছে নারীকে। তবে গড় ধরলে সমান-সমানই। অর্থাৎ, এ জায়গায় অন্তত নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দেশে!

অথচ তারপরও আমাদের দেশের অনেক পুরুষ নারীদের খোঁটা দিয়ে যাবেনই। অন্তত অর্থনৈতিকভাবে তো অবশ্যই। কারণ আর্থিক বিষয়-আসয়ে নারীর ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিতে এ দেশের পুরুষের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই। আর এই হারানোর ভয় থেকেই হয়তো পুরুষের ঈদের বাজেট কম কেন–এ সংক্রান্ত প্রশ্ন ওঠে আমাদের সমাজে। আদতে এসব নারীকে সামগ্রিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করারই এক ধরনের চেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় কি?

এই সমাজে অন্তত একটি বিষয় প্রতিষ্ঠিত হয়েই আছে যে, পুরুষেরা অর্থ উপার্জনকারী এবং নারীরা অর্থব্যয়কারী। আর এর মধ্যেই পুরুষের রক্ত জল করে পরিবারের খরচ মেটানোর মহত্ব গুঁজে দেওয়া হয় সন্তর্পণে। আবার গৃহস্থালি কাজে নারীর অবদানকে আর্থিক মূল্যে বিচার করার চেষ্টা হয় না কখনোই। ওটি যেন কোনো কাজই নয়।

নারীকে অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পুরুষেরা কি বাধা হিসেবে কাজ করে না এ সমাজে? জরিপ বা গবেষণা দেখার প্রয়োজন নেই। স্রেফ নিজের ঘরে চোখ রাখুন, পর্যবেক্ষণ করুন। দেখবেন, আপনি নিজেই কত সময় বাধা হিসেবে উপস্থিত হয়েছেন! আবার সব বাধা পেরিয়ে যেসব নারী তবুও উপার্জনকারী হতে চান, তার ওপর পারিবারিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয় ঘর ও কর্মস্থল সামলে চলার গুরুভার। আপনার আশপাশে স্বামী-সন্তানের জন্য ভাত রেঁধে কত নারী কর্মস্থলে যান, সেই হিসাবটা করুন প্লিজ। উত্তর পেয়ে যাবেন।

এভাবে নানা বাঁধনে বেঁধে এই সমাজ আবার নারীকে শুনিয়ে দেয়, ঈদে তার বাজেট বেশি! আর তাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দলে দলে পুরুষতান্ত্রিক নারী-পুরুষেরা এসে লাভ রিঅ্যাক্ট দিয়ে যান। ‘দায়িত্বশীল’ সংবাদমাধ্যম তা আবার ঘটা করে প্রচারও করে। কারণ, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে রিচ বাড়লেই যে লাভ। সমাজের ভেতরে ঘুণপোকা ঢুকে ক্ষত গভীর করছে কিনা, সেসব দেখার সময় কোথায়! এভাবেই আমরা এমন একটি সমাজ বানাচ্ছি, যেটি প্রায় শতবছর আগে নজরুলের বলে যাওয়া নর-নারীর সমতাবিষয়ক বক্তব্যকেও আর আমলে নিতে চায় না, মানতেও পারে না। কারণ প্রচলিত ভূতের গল্পের মতো আমাদের পা দুটো যে উল্টে গেছে একেবারেই। তাতে শুধু পেছনে যাওয়াই হয়, সামনে নয়।