Hathazari Sangbad
হাটহাজারীরবিবার , ২৯ জানুয়ারি ২০২৩
আজকের সর্বশেষ সবখবর

আজ ‘সুলতানুল হিন্দ’ খাজা আজমিরী (রহ.) ওফাত দিবস

অনলাইন ডেস্ক
জানুয়ারি ২৯, ২০২৩ ৩:৫৪ অপরাহ্ণ
Link Copied!

৬ রজব সুলতানুল হিন্দ হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.) এর সর্বসম্মত ওফাত দিবস আজ। এই উপমহাদেশে তিনি ছিলেন চিশতিয়া তরিকার প্রবর্তক। তাঁর বিভিন্ন উপাধি ছিল। যেমন- কুতুবুল আরেফীন, গাউসুল মাশায়েখ, সুলতানুল হিন্দ প্রভৃতি। তাঁর পিতা সৈয়দ গিয়াসউদ্দীন হাসান (রহ.) ছিলেন একজন উচুস্তরের আলেম, সাধক। খোরাসানের বিশিষ্ট উলামা-মাশায়েখের মধ্যে তাকে গণ্য করা হতো এবং সকলের নিকট তিনি ভক্তি ও সম্মানের অধিকারী ছিলেন। তিনি হজরত ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা.) এর বংশধর ছিলেন। কোন কোন সীরাত পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে, সৈয়দ গিয়াসউদ্দীন হাসান (রহ.) হজরত শেখ আব্দুল কাদের জীলানী (রহ.) এর মামা ছিলেন।

হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) এর মাতার নাম মাহেনূর এবং উপাধি ছিল উম্মুল ওয়ারা। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মোহাম্মদ দাউদ। তিনি ছিলেন হজরত ইমাম হাসান (রা.) এর বংশধর। একটি বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত খাজা (রহ.) হিজরী ৫৩৭ সালের ১৪ রজব ইস্ফাহানে জন্ম গ্রহণ করেন। এটি ছিল আব্বাসীয় খলিফা মোসতারশেদ বিল্লাহ এর যুগ। বাল্যকালেই তাঁর পিতা-মাতা ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১২ বছর। পৈত্রিক সম্পদের মধ্যে তিনি একটি বাগান ও চাকী (পেষণ যন্ত্র) পেয়েছিলেন। খাজা সাহেব বাগানটি দেখভাল করতেন।

একদিন ইবরাহীম কলন্দর নামক এক মাজযুব বাগানে আসেন। খাজা সাহেব তাকে আঙ্গুরের একটি গুচ্ছ পেশ করেন। কিন্তু মাজযুব আঙ্গুর না খেয়ে দাঁতে চিবিয়ে খাজা সাহেবের মুখে দেন। তা খাওয়া মাত্র খাজা সাহেবের অন্তর নূরে এলাহীতে আলোকিত হয়ে উঠে। তিনি দুনিয়ার সম্পর্ক ত্যাগ করে খোদাপ্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বের হয়ে পড়েন এবং সমরখন্দে পৌঁছেন। সেখানে তিনি কোরআন হিফজ করেন এবং জাহেরী সকল শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করেন। সমরখন্দ হতে তিনি ইরাকের দিকে যাত্রা করেন। বাগদাদের হারুন নামক কসবায় তিনি হজরত শেখ উসমান হারুনী (রহ.) এর খেদমতে হাজির হন, তাঁর হাতে বয়াত হন এবং সেখানে আড়াই বছর অবস্থান করেন। অতঃপর তার পীর মুর্শিদের সঙ্গে মক্কা মোআজ্জামা ও মদীনা মোনাওয়ারা জিয়ারত করেন। শেখ হারুনী তাঁর জন্য আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দরবারে দোয়া করেন। তখন গায়ব হতে আওয়াজ আসে, ‘মুঈনুদ্দীন দোস্ত মাস্ত, উরা কবুল করদাম, ওয়া বরগজিদাম।’ তোমাকে কবুল করেছি এবং মনোনীত করেছি।

ভারত বর্ষে হজরত খাজা সাহেবের ইসলাম প্রচার সম্পর্কে বিখ্যাত ঐতিহাসিক লেখক আর্লেন্ডের ভাষ্যে শোনা যাক, ‘হিন্দুস্তানের সুপ্রসিদ্ধ ও বিখ্যাত আউলিয়ায়ে কেরামের মধ্যে খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) একজন, যিনি রাজপুতনা রাজ্যে ইসলাম প্রচার করেন এবং ৬৩২ হিজরী মোতাবেক ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে আজমীরে ইন্তেকাল করেন। এ সাধক সিজিস্তানের অধিবাসী ছিলেন, যা ইরানের পূর্বে অবস্থিত। খ্যাত আছে যে, খাজা সাহেব যখন মদীনা জিয়ারতে যাচ্ছিলেন, তখন তাঁর প্রতি নির্দেশ আসে হিন্দুস্তানে ইসলাম প্রচারের। আল্লাহর পয়গম্বর (সা.) স্বপ্নে হাজির হন এবং বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা হিন্দুস্থান তোমার হাওলা করেছেন। যাও এবং আজমীরে বসবাস অবলম্বন কর। আল্লাহর মদদে ইসলাম ধর্ম তোমার এবং তোমার ভক্ত অনুসারীদের পবিত্রতায় এই ভূখন্ডে প্রসার লাভ করবে।’

খাজা সাহেব এ নির্দেশ পালন করেন এবং আজমীরে চলে যান। যেখানের রাজা ছিল হিন্দু এবং সেখানে চার পাশে মূর্তিপূজা ছড়িয়ে পড়েছিল। ঐ স্থানে পৌঁছার পর তিনি যে হিন্দুকে সর্ব প্রথম মুসলমান করেন, সে ছিল একজন যোগী। ক্রমে বহু লোক খাজা সাহেবের ভক্ত হয়ে পড়ে এবং মূর্তিপূজা ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এরপর খাজা সাহেবের খ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বশেষে হিন্দুরা দলে দলে খাজা সাহেবের খেদমতে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। খ্যাত আছে যে, খাজা সাহেব যখন দিল্লী হতে আজমীরে যাচ্ছিলেন তখন সাতশত (৭০০) হিন্দুকে তিনি মুসলমান করেন।

হজরত খাজা সাহেবের তবলিগী সাফল্য সম্বন্ধে সিয়ারুল আউলিয়ার লেখক বলেছেন, ‘তাঁর আগমনের পূর্বে সমগ্র হিন্দুস্থানে কোফর ও মূর্তিপূজার প্রচলন ছিল এবং সেখানের প্রত্যেক ব্যক্তি পাথর, ঢিলা, বৃক্ষ, চতুষ্পদ জন্তু, গরু এবং তার গোবরকে সেজদা করত এবং কোফরের অন্ধকারে তাদের অন্তরসমূহের তালা আরো মজবুত হচ্ছিল। কিন্তু খাজা সাহেবের ভারতবর্ষে আগমনে কোফরের অন্ধকার ইসলামের নূরে আলোকিত হয়ে ওঠে।’

সীরাত লেখকদের বর্ণনা অনুযায়ী, হজরত খাজা সাহেব কুঁড়ি বছর পর্যন্ত খাজা উসমান হারুনী (রহ.) এর খেদমতে ছিলেন এবং সার্বক্ষণিক তাঁর সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। অতঃপর খেলাফত লাভে ধন্য হয়ে তিনি হিন্দু রাজা পাথুরা রায়ের রাজত্বকালে আজমীরে গমন করেন এবং আল্লাহর এবাদত বন্দেগীতে মশগুল হয়ে যান। এ রাজা ছিল কট্টর কাফের, অহংকারী, চরম ইসলাম বিদ্বেষী, এমনকি নিজেকে খোদা বলে দাবিদার। মূর্তিপূজারীরাও তার পূজা করতে বাধ্য হতো। এ সময় পাথুরা রায়ও স্বয়ং আজমীরে অবস্থান করছিল। একদিন পাথুরা কর্তৃক হজরত খাজার এক মুসলমান ভক্ত কোন কারণে হয়রানির শিকার হয়। লোকটি খাজা সাহেবের নিকট ফরিয়াদ পেশ করেন। খাজা সাহেব পাথুরার নিকট একখানা সুপারেশীপত্র প্রেরণ করেন। পাথুরা শেখের পত্র আমলে আনার পরিবর্তে মন্তব্য করে যে, লোকটি এখানে এসেছে এবং বসে বসে গায়বী কথাবার্তা বলে। খাজা সাহেব যখন এ খবর জানতে পারেন তখন বলেন, ‘পাথুরারা জিন্দা গ্রেফতিম ওয়া দাদিম।’ অর্থাৎ ‘আমরা পাথুরাকে জীবিত ধরে দিয়েছি।’ আল্লাহর ইচ্ছায় পাথুরা জীবিতই ধরা পড়ে। সে সময় গজনি হতে সুলতান মোয়েজুদ্দীন সাম (সুলতান শাহাবুদ্দীন ঘোরী) তার বাহিনীসহ হামলা করেন। পাথুরা মুসলিম বাহিনীর মোকাবিলা করে গ্রেফতার হয় এবং নিহত হয়। এ বিজয়ের পর সর্বত্র ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং কোফর ও ফেতনার মূল উৎপাটিত হতে থাকে। বলা হয়, ওফাতের পর হজরত খাজা গরীব নাওয়াজ (রহ.) এর কপাল মোবারকে এই বাক্যটি প্রকাশ পায়, ‘হাবিবুল্লাহ মাতা ফি হোব্বিল্লাহ’। অর্থাৎ ‘আল্লাহর হাবিব আল্লাহর মোহাববতেই বিলীন হয়ে গেছেন।’

হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) এর জন্ম হিজরী ৫৩৭ সালে এবং ওফাত ৬৩৩ সালে। এ হিসাবে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। তাঁর তাবলিগী সময়কাল ৭,২০০ দিন। ৫৪৪ সালে তিনি নিশাপুর মাদরাসায় ভর্তি হন। ৫৪৮ সালে গজনিতে আক্রমণকালে তাঁর পিতা গিয়াসউদ্দীন হাসান শহীদ হন। ৫৫০ সালে তাঁর মাতা ইন্তেকাল করেন। দুই বছর পর ৫৫২ সালে ইলম হাসিল করার জন্য তিনি বিভিন্ন ইসলামী দেশ সফর করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর। পাঁচ বছরে তিনি সকল জাহেরী ও বাতেনী বিদ্যায় পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করেন এবং বাড়িতে প্রত্যাবর্তন করে সুখী জীবন যাপন করতে থাকেন।

হজরত খাজা সাহেবের ওপর স্বতন্ত্র কোন গ্রন্থ নেই। তার মালফুজাত অর্থাৎ বাণীসমূহকে তিনটি রচনা গ্রন্থ হিসেবে তারই মনে করা হয়। এ তিনটি বাণী সম্বলিত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘আনিসুল আরওয়াহ’, ‘রেসালাদর কসবে নফস’ এবং ‘দলীলুল আরেফীন’। ‘আনিসুল আরওয়াহ’ গ্রন্থে খাজা সাহেব তাঁর পীর মুর্শিদ খাজা উসমান হারুনী (রহ.) এর ২০টি অধিবেশেনের মালফুজাত (বাণীসমূহ) একত্রে সংকলন করেন। এসব মালফুজাতে বিশেষভাবে তাসাউফের গুরুত্বপূর্ণ ও সুক্ষ্ণ বিষয়গুলোর আলোচনা রয়েছে। এমন কি মালফুজাতের মাধ্যমে কোন কোন শরয়ী, আখলাকী (নৈতিক) এবং জাগতিক বিষয়াবলীর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ‘দলীলুল আরেফীনে’ খাজা সাহেবের এগারটি অধিবেশনের মালফুজাত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাতে ধর্মীয় বিভিন্ন মাছআলা, সূফিতত্ত¡ ছাড়াও শরীয়ত, হাকীকত, তরীকত, মোহাব্বতে এলাহী এবং কাশফ ও কারামত ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে। খাজা সাহেবের এসব মালফুজাত তাঁর অমূল্য আদর্শ-শিক্ষার পরিচয় বহন করে। ‘দলীলুল আরেফীন’ তাঁর প্রধান খলিফা কুতুবুল আকতাব হজরত বখতিয়ার কাকী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত। মোটকথা, যেসব আধ্যাত্মিক সাধক কবর হতে দুনিয়া শাসন করেন ‘সুলতানুল হিন্দ’ হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.) তাদের একজন।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ৬৩৩ হিজরীর ৫ই রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ই রজব সুবহে সাদেকের সময় ইন্তেকাল করেন। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। ওফাতের সাথে সাথে তাঁর পবিত্র কপাল শরীফ-এ স্পষ্টভাবে আরবীতে স্বর্ণোজ্বল নুরানী অক্ষরে লিখা হয়ে যায় “হাযা হাবীবুল্লাহ মা-তা ফি হুব্বিল্লাহ” অর্থাৎ ইনি আল্লাহর বন্ধু, আল্লাহর মুহব্বতেই তিনি বিসাল লাভ করেছেন।

গরীবে নেওয়াজের বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হযরত খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার খাকী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে খিলাফতের দায়িত্ব অর্পন করে সিলসিলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখেন।