এটা তো সত্যি যে, এবারের ইউরো কাপের শিরোপা জিততে যাচ্ছে হয় স্পেন, নয়তো ইংল্যান্ড। তিনবারের ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন কী সংখ্যাটা চারে উন্নীত করবে নাকি প্রথমবারের মত ইউরো কাপের শিরোপা ঘরে তুলবে ইংল্যান্ড- বার্লিনে সেটারই নিষ্পত্তি হবে, এই যা!
সবচেয়ে বড় কথা, ১৯৬৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের ৫৮ বছর পর কী আরও একটি বড় শিরোপা জিততে যাচ্ছে ইংল্যান্ড? নাকি তারুণ্যের পসরা সাজিয়ে যে ভয়ঙ্কর সুন্দর ফুটবল উপহার দিচ্ছে স্প্যানিশরা- তার জয় হবে? বার্লিনে মিলবে সে প্রশ্নের উত্তর।
একদিকে স্পেন, যাদের অস্ত্র পাসের ফুলঝুরির সঙ্গে গতি মিশিয়ে জমাটবদ্ধ আক্রমণ। আরেকটা দল কৌশলে একটু ধীরগতির, কিন্তু ৯০ মিনিটই অকুতোভয়। এক দলের কোচ নির্দিষ্ট কোনও নেতায় বিশ্বাস করেন না। আরেক দলের কোচ বড় নামকে বসিয়ে দিতে ভয় পান ঠিকই, কিন্তু দলের তরুণ ফুটবলারদের এগিয়ে দিতেও দ্বিধা করেন না।
ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে স্পেন বনাম ইংল্যান্ডের শিরোপাযুদ্ধে এমন অনেক বিষয়ই আছে, যা ফাইনাল ম্যাচের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে দেবে। খাতায়-কলমে যে দলই এগিয়ে থাকুক, যুদ্ধের শেষে কোন দল শেষ হাসি হাসবে তা নিয়ে বাজি ধরা বেশ কঠিন।
২০০৮ থেকে ২০১২- স্বপ্নের মত চারটি বছর কাটিয়েছে স্পেন। যেখানে দুটো ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ এবং একটি বিশ্বকাপ। স্পেনের সোনালি প্রজন্ম বলা হয় তাদেরকে। বিশ্বের সেরা দল। জাদুর মতো মোহনীয় ‘তিকিতাকা’ ফুটবল উপহার দিয়েছিলো যারা।
স্পেনের ফুটবলের পাশে বসানোর মতো বিশেষণের কোনও কমতি ছিল না ওই সময়ে। কত কী-ই না লেখা হয়েছে ‘লা রোজা’দের নিয়ে। সেই দুর্গে প্রথম ফাটল ধরে ২০১৩ সালে, ব্রাজিলের কাছে কনফেডারেশন্স কাপ ফাইনালে হারের পর। দ্বিতীয় ধাক্কা ২০১৪ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে নেদারল্যান্ডসের হাতে ১-৫ গোলে চূর্ণ হওয়ার পর। তৃতীয় ধাক্কা ২০১৬’র ইউরোয় ইতালির কাছে হেরে বিদায় নেওয়ার পর।
২০১২ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ের পর থেকে কত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই না গেছে স্পেন। ফুটবলের ইতিহাসে কোনও সাম্রাজ্য এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে কেউ কখনও দেখেনি। যারাই নতুন সাম্রাজ্য গড়েছে, অন্তত এক-দু’দশক থেকেছে। স্পেন ছিল ব্যতিক্রম। যত দ্রুত তারা ফুটবলবিশ্বের উপরে উঠে এসেছিল, তত দ্রুত তাদের পতন হয়। একটা প্রজন্ম দলকে সাফল্যের শিখরে তুলেও চূড়ান্ত ব্যর্থতার মধ্যে বিদায় নিতে বাধ্য হয়।
বার্সেলোনায় পেপ গার্দিওলা এবং জাতীয় দলে ভিসেন্তে দেল বস্কের হাত ধরে যে নবজাগরণ স্পেনের ফুটবলে শুরু হয়েছিল, তা শেষ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। ২০১৬’র ইউরো থেকে বিদায় নেওয়ার পর স্পেনের বেশির ভাগ পত্রিকায় ফলাও করে লেখা হয়েছিলো, ‘সব শেষ’। ২০১৮ বিশ্বকাপে রাশিয়ার কাছে হার সেই ধারণা আরও পোক্ত করে। ২০২০ ইউরোয় কিছুটা ভাল খেললেও, ২০২২ বিশ্বকাপে মরক্কোর মতো দলের কাছে হার। ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ আর কিছু ছিল না।
তবে অন্যভাবে ভেবেছিলেন একজন। তিনি লুইস ডি লা ফুয়েন্তে। লুইস এনরিকেকে সরিয়ে তাকে কোচ করে আনার পর অনেকেই রয়্যাল স্প্যানিশ ফুটবল ফেডারেশনের সমালোচনা করেছিলেন; কিন্তু তাদের সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না তার প্রমাণ এবারের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ।
ফুয়েন্তের শুরুটা হয়েছিল খারাপভাবেই। শুরুতেই স্কটল্যান্ডের কাছে ০-২ গোলে হার। তবে তাতে স্পেন ফুটবল ফেডারেশন হারায়নি। ভরসা রেখেছিল ফুয়েন্তের উপরে। তারই পুরস্কার পাচ্ছে এবার স্পেন। গত বছর নেশন্স লিগ জিতে ১১ বছরের ট্রফি খরা কাটিয়েছিল স্প্যানিশরা। এবার ইউরো জিতে তাদের সামনে বড় মঞ্চে আবারও দাপট প্রমাণ করার সুযোগ।
স্পেনের এই দলে বড় কোনো নাম নেই। এই দলে ৩৮ বছরের জেসাস নাভাসও খেলেন। এই দলে খেলেন ১৬ বছরের লামিনে ইয়ামালও। এই দলে যেমন ক্লাব স্তরে সাফল্য পাওয়া রদ্রির মতো ফুটবলার রয়েছেন, তেমনই চেলসিতে ব্যর্থ মার্ক কুকুরেয়া বা আল নাসরে নজর কাড়তে না পারা আয়মেরিক লাপোর্তেও আছেন। কিন্তু তারকা না থাকাই বাড়তি সুবিধা স্পেনের। কোচ ফুয়েন্তে বলেছেন, ‘আমার হাতে ২৬ জন ফুটবলার রয়েছে এবং আমি ভাগ্যবান যে তারা সবাই স্প্যানিশ।’
ইংল্যান্ডের কোচ সাউথগেট বড় নামকে বসাতে ভয় পান। ফ্রান্সের কোচ দিদিয়ের দেশম কিলিয়ান এমবাপে-নির্ভর দল থেকে বেরোতে পারেননি। সেখানে ফুয়েন্তের দলে সবাই নেতা। সবার ভূমিকা, সবার নির্দিষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি কাজে লাগিয়ে দলটাকে সঠিক পথে এগিয়েও নিয়ে যাচ্ছেন।
এই দল সোনালি প্রজন্মের মতো ‘তিকিতাকা’ খেলে পাসে পাসে ভরিয়ে দেয় না। আবার তুমুল আক্রমণ করে কাউন্টার অ্যাটাকে গোলও খায় না। তারা পাস খেলে। খেলতে খেলতেই চকিতে বিপক্ষের বক্সে ঢুকে পড়ে। পুরো ব্যাপারটা মাখনের উপরে ছুরি চালানোর মতোই মসৃণ।
এই যদি স্পেনের বৃত্তান্ত হয়, তা হলে সাউথগেটের ইংল্যান্ডও পিছিয়ে থাকবে না। রোববারের ফাইনালে নামার আগে ইংলিশ সমর্থকরাও ট্রফি জয়ের আশায় বুক বাঁধছেন। কারণ শেষ কয়েক বছরে ইংল্যান্ড বদলে গেছে। গ্যারেথ সাউথগেটের প্রশিক্ষণে ইংল্যান্ড এখন নকআউটে আর কেঁপে ওঠে না। টাইব্রেকারে জিততে জানে। রোববার রাতে যে ইংল্যান্ড দল খেলতে নামবে, তাদের সেই হার না মানা মনোভাব সত্যিই সবার কাছে অপরিচিত।
এবারের ইউরো চ্যম্পিয়নশিপে ইংল্যান্ড কখনও ভাগ্যের সাহায্য পেয়েছে, কখনও পেনাল্টিতে গোল করে জিতেছে, কখনও শেষ মিনিটের গোলে জিতেছে। আগে সাধারণত এগুলি ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে হত। কিন্তু এবারের ইউরো কাপে ইংল্যান্ডের জার্সিধারী ফুটবলারেরাই এসব কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
১৯৬৬ সালের বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে পশ্চিম জার্মানিকে ৪-২ গোলে হারিয়ে জিতেছিল ইংল্যান্ড। সিনিয়র ফুটবলে সেটাই ইংল্যান্ডের একমাত্র ট্রফি। ৫৮ বছর পর আবারও ট্রফি জয়ের সুযোগ। স্পেন বাধা পার হতে পারলেই ইতিহাস সৃষ্টি করে ফেলবেন হ্যারি কেইনরা।
এবারের ইউরো কাপে বদলে যাওয়া ইংল্যান্ড দল সম্পর্কে কোচ সাউথগেট বলেন, ‘আমরা শুধু একটা প্রতিযোগিতা নিয়ে ভাবিনি। শুধু একমুখি পড়াশোনা করিনি। এই দলটা আলাদা।’
২০১৬ সালে দায়িত্ব দেওয়া হয় সাউথগেটকে। আইসল্যান্ডের কাছে হেরে ইউরো থেকে বিদায় নেওয়ার পরপরই কোচ করা হয়েছিল তাকে। সাউথগেটের প্রশিক্ষণে বদলাতে থাকে ইংল্যান্ড। ২০১৮ সালে বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলে। ২০২১ সালে ইউরো কাপের ফাইনালে ওঠে।
শেষ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। এবারের ইউরো কাপে আবার ফাইনালে হ্যারি কেনেরা। গত ৭০ বছরে একবার কোনও প্রতিযোগিতার ফাইনাল খেলেছিল ইংল্যান্ড। গত আট বছরে সেখানে দ্বিতীয় ফাইনাল খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাউথগেটের ছেলেরা।
ইংল্যান্ড জিতলেও হ্যারি কেইনদের খেলা মন জিততে ব্যর্থ। বারবার বড় প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া সমর্থকরা বুঝতেই পারছেন না ফিল ফোডেন, জুদ বেলিংহ্যামদের ‘কুৎসিত’ ফুটবল দেখে কিভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা উচিত। তারা অভ্যস্ত ছিলেন বীরের মতো খেলে হেরে যাওয়া দেখতে, কিন্তু এখন দেখছেন কোনও মতে জিতে যাওয়া। ইংরেজ দল এখন অনেক বেশি যান্ত্রিক। তারা যে কোনও ভাবে জিততে জানে।
ইংল্যান্ড বুঝেছিল সিনিয়র ফুটবলে ট্রফি জিততে হলে, কাজটা শুরু করতে হবে জুনিয়র ফুটবল থেকেই। ১৯৬৬ সালের পর সিনিয়র দল কোনও ট্রফি জিততে না পারলেও ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-২০ এবং অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ জিতেছিল ইংল্যান্ড। গত বছর অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো কাপ জিতেছিল তারা। সেটাও আবার স্পেনকে হারিয়ে।
রোববার সেই দেশের বিরুদ্ধেই খেলবে ইংল্যান্ড। গত বছর অনূর্ধ্ব-২১ ইউরো কাপ জেতা ইংরেজ দলে ছিলেন অ্যান্থনি গর্ডন এবং কোল পালমার। ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপজয়ী ইংল্যান্ড দলের সদস্য ছিলেন ফিল ফোডেন, মার্ক গেহি এবং কনর গ্যালাগার। ফোডেন সেই প্রতিযোগিতায় সোনার বল জিতেছিলেন। এজরি কোনসা ছিলেন অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপজয়ী দলে। এই ছ’জন ফুটবলারই রবিবারের সিনিয়র ইংল্যান্ড দলে রয়েছেন।
ইংল্যান্ডের ফুটবল নিয়ামক সংস্থার ডিরেক্টর ড্যান অ্যাশওয়ার্থ বলেন, ‘আমরা একটা মন্ত্রে বিশ্বাসী। জার্সির মাপটা শুধু বদলাবে।’ তাই অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে সিনিয়র দলে উঠে আসছেন ফুটবলাররা। ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলছে। সবার এক লক্ষ্য নিয়ে খেলছে। এক রকম ভাবনায় খেলছে। সেটাই আমাদের সাফল্য এনে দিয়েছে।’
সাউথগেটের যে দল জার্মানিতে ইউরো কাপ খেলছে, তাদের ফুটবলে পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু দৃষ্টিসুখ নেই। গ্রুপ পর্বে দু’টি ম্যাচ ড্র করেছিল ইংল্যান্ড। মাত্র দু’টি গোল করেছিল। ইংল্যান্ডের সংবাদমাধ্যম সেই সময় ছিঁড়ে খাচ্ছিল সাউথগেটকে। তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই ভালবাসা চাই। দেশের হয়ে কিছু করার সময় গর্ব বোধ হয়। কিন্তু সেটা ফেরত না পেলে খারাপ লাগে। সমালোচনা হজম করা বেশ কঠিন।’
ইংল্যান্ড সমালোচনা হজম করেনি। বরং ফিরে এসেছে। প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছে। নকআউট পর্বে জিতেছে। টাইব্রেকারে জিতেছে। কিছু ক্ষেত্রে যা প্রত্যাশিত ছিল। উদাহরণ, প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের জুদ বেলিংহ্যামের ৯৫ মিনিটের গোল। কিছু ক্ষেত্রে ছিল চমক।
উদাহরণ, লিভারপুলের ট্রেন্ট অ্যালেক্সান্ডার-আর্নল্ডকে শুধুমাত্র টাইব্রেকারের জন্য দলে আনা এবং তার করা গোলে জিতে সেমিফাইনালে ওঠা। কিছু ছিল অপ্রত্যাশিত। উদাহরণ, অ্যাস্টন ভিলার অলি ওয়াটকিন্স পুরো ইউরো কাপে খেলেছেন ৩১ মিনিট এবং তার করা গোলেই নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে জিতে ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড।
কোচ সাউথগেটের মতে, এটাই নতুন ইংল্যান্ড। যে দল লড়তে জানে, যে দল নিজের জাত চেনাতে জানে।