Hathazari Sangbad
হাটহাজারীবুধবার , ১৮ জানুয়ারি ২০২৩

অবশেষে পরিবার খুঁজে পেলেন সৌদিফেরত সেই বৃদ্ধ

অনলাইন ডেস্ক
জানুয়ারি ১৮, ২০২৩ ১০:১৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

এ যেন নাটক-সিনেমার কোনো দৃশ্য! দীর্ঘ ২৫ বছর পর বাবার সঙ্গে সন্তানদের দেখা। দেশে ফেরার পর যে মানুষটি পরিবারই খুঁজে পাচ্ছিলেন না, অবশেষে চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকায় তাঁর পরিবারের সন্ধান মিলল। চট্টগ্রাম থেকে আজ বুধবার তাঁরা ঢাকায় এসে পৌঁছেন। এরপর বিকেলে আবুল কাশেম নামের ওই বৃদ্ধকে তাঁর পুত্র, কন্যাসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান। বিকেলে তাঁরা চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন।
এ সময় এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক স্কোয়াড্রন লিডার মো. রাসেল তালুকদার, সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল হান্নান রনি এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক ফখরুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
 
গত শুক্রবার দিবাগত রাতে সৌদি আরব থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছিলেন এই বৃদ্ধ। কিন্তু তিনি নিজের ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। তাঁর কাছে পাসপোর্টও ছিল না। অনেক কিছু ভুলে গিয়েছেন। এরপর বিমানবন্দরের পুলিশ তাকে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে পাঠায়। তাঁর খোঁজ পেতে ব্র্যাকের কর্মীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় খোঁজখবর শুরু করেন। গণমাধ্যমেও বিষয়টি জানানো হয়। এরপর চট্টগ্রামের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়রের সহায়তায় তাঁর পরিবারের সন্ধান মেলে।
 
হস্তান্তরের আগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রগ্রামের কর্মসূচি প্রধান শরিফুল হাসান জানান, বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশসহ সবার সহযোগিতায় বিদেশফেরতদের জন্য আমরা নানা ধরনের সেবামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি। এরই অংশ হিসেবে বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটি ও মাইগ্রেশন পুলিশ শনিবার বিকেলে ওই বৃদ্ধকে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে দেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের তথ্য অনুযায়ী এই বৃদ্ধ সম্ভবত শুক্রবার দিবাগত রাতে জেদ্দা থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেছেন। তাঁর কাছে কোনো পাসপোর্ট ছিল না। তিনি ট্র্যাভেল পাস নিয়ে এসেছেন।
 
শরিফুল হাসান জানান, শারীরিকভাবে সুস্থ মনে হলেও সম্ভবত তিনি ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত। এ কারণেই তিনি সঠিকভাবে তাঁর ঠিকানা বলতে পারছেন না। তিনি জানাচ্ছেন, তাঁর নাম আবুল কাশেম। পিতার নাম ফজেল আহমেদ। মাতা সাবানা। স্ত্রীর নাম বলছেন আমেনা। নিজের ঠিকানা তিনি কখনো বলছেন চট্টগ্রামের নয়াবাজার। কখনো বলছেন টেকনাফ। আবার কখনো রাউজানের পাহাড়তলী ইউনিয়নের গরিশংকরহাটের কথাও বলছেন। আবার বলছেন, চট্টগ্রামের নতুন বাজার হালিশহরের কাছে, ঈদগাহের মাঠ বউবাজার এলাকায় তাঁর ছেলের তরকারির দোকান আছে। আমরা তাঁর বাড়ি কোথায় নিশ্চিত হতে না পারলেও ভাষা শুনে এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম তার বাড়ি চট্টগ্রাম অঞ্চলে।
 
আবুল কাশেম দাবি করছিলেন, তাঁর ছয় মেয়ে ও তিন ছেলে রয়েছে। তাঁর তিন ছেলের নাম মান্নান, নূর হাসান, এনামুল হাসান। এর মধ্যে নূর হাসানের তরকারির দোকান আছে। ছোট ছেলে এনামুল হাসান দুবাই থাকেন। মান্নান সৌদি থাকেন বলে দাবি তাঁর। ৮-১০ জন নাতি-নাতনি আছে। কিন্তু যেহেতু দীর্ঘ ২৫ বছর দেশে নেই, সঠিকভাবে সব বলতে পারছিলেন না। তবে তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় কথা বলছিলেন, কাজেই আমরা চট্টগ্রামের পুলিশসহ নানা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা তাঁর পরিবারের সন্ধানে গণমাধ্যমকর্মীদের সহায়তা চাই। অনেকেই তাঁর বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ করেন। এরপরও আমরা পরিবারের সন্ধান পাচ্ছিলাম না।
 
শরিফুল হাসান জানান, তিনি যখন যেসব এলাকার কথা বলছিলেন আমাদের চট্টগ্রামের ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রগ্রামের কর্মীরা সেসব এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন। ওই বৃদ্ধ বলছিলেন, চট্টগ্রামের নয়াবাজার এলাকায় তাঁর ছেলে তরকারি বিক্রি করে। সেই কথার ওপর ভিত্তি করে আমাদের চট্টগ্রাম টিম ‘পরিবারের সন্ধান চাই’ শিরোনামে ছবিসহ শত শত পোস্টার বিলি করে। চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর, নয়াবাজার, বউবাজার, ঈদগাহ, পাহাড়তলীসহ আরো বেশ কয়েকটি স্থানে দেয়ালে দেয়ালে আমরা পোস্টার লাগাই। আমরা বিশ্বাস রেখেছিলাম, গণমাধ্যমকর্মীসহ সবার সহযোগিতায় আমরা তাঁর পরিবারকে খুঁজে বের করতে সক্ষম হব।
 
শরিফুল হাসান জানান, এসব পোস্টার দেয়ালে লাগানো ও বিতরণ করার পর মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রামের আমাদের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র আব্দুস সবুর লিটন যোগাযোগ করেন। তিনি জানান, পোস্টারের ছবির লোকটিকে তিনি চিনতে পেরেছেন। এরপর আমাদের লোকজন তাঁর অফিসে যায়। তাঁর সহযোগিতায় আমরা তাঁর ছেলে সবজি ব্যবসায়ী নূর হাসানের খোঁজ পাই। পরবর্তী সময়ে কাউন্সিলর অফিসে তাকে এনে কথা বলে জানতে পারি, আবুল কাশেম তাঁর বাবা। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র দেখেও আমরা বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছি। নূর হাসানের কাছ থেকে আমরা পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলি। দুবাইতে থাকা তাঁর এক ছেলের সঙ্গেও কথা বলি। এরপর বৃদ্ধ আবুল কাশেমের ছোট মেয়ে রুমা বেগম ও তার স্ত্রী আমেনা বেগমের সঙ্গে ঢাকা থেকে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিই। এরপরই আমাদের লোকজনের সঙ্গে পরিবারের সদস্যরা তাকে নিতে ঢাকায় রওনা হন।
 
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিদেশফেরত আবুল কাশেমের বড় ছেলে নূর হাসান। তিনি তার বাবাকে ফিরে পেয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ব্র্যাকসহ আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
অনেক দিন ধরে বাবার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আমরা জানতাম না তিনি সৌদি আরবের কোথায় আছেন। তিনি যে দেশে এসেছেন সেটাও আমরা জানতাম না। পোস্টার দেখে ও স্থানীয় কাউন্সিলরের মাধ্যমে ব্র্যাকের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ হয়। আমরা তার পরিবারের সদস্য হয়েও যা করতে পারিনি ব্র্যাক আমার বাবার জন্য তার চেয়ে বেশি কিছু করেছে।
 
সংবাদ সম্মেলনে অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক বলেন, বাবা-সন্তানের দেখা হওয়ার যে দৃশ্য এটি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। আমরা অনেক দিন ধরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রগ্রামের সঙ্গে কাজ করছি। এই প্রবাসীকেও আমরা মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় ব্র্যাকের কাছে দিয়েছিলাম।
 
স্কোয়াড্রন লিডার রাসেল তালুকদার বলেন, ২৫ বছর পর নিজ দেশে ফেরত এসেছেন এমন একজন অভিবাসীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হলো। এমন ঘটনা আমরা সব সময় সিনেমায়ই দেখি, বাস্তবে এই প্রথম আমি ঘটনার সাক্ষী হলাম।
 
দীর্ঘদিন পর পরিবারকে পেয়ে আবুল কাশেম তাঁর সন্তানদের বারবার জড়িয়ে ধরছিলেন। তাঁকে নিতে আসা কন্যা পারভীন আক্তার বলেন, আমার বাবা যখন ২৫ বছর আগে সৌদি আরবে যান, অমার ছোট বোন রুমা তখন মায়ের পেটে। বাবার সঙ্গে আমাদের স্মৃতি খুব কম। আমরা এখন বাবাকে ফেরত পেলাম। আমাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।