বগুড়ায় ক্লিনিক থেকে চুরি হওয়া ছেলে সন্তানকে ফিরে পেতে সংবাদ সম্মেলনে আকুতি জানিয়েছেন মা। সন্তানকে কাছে পেতে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে আইনি লড়াই চালিয়ে আসছেন মা তাজমিনা আক্তার।
নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালতে দৌড় ধাপ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন এই মা। নিম্ন আদালতে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখায় উচ্চ আদালতে রিট করলেও আইনজীবীদের জালিয়াতির কারণে সন্তানকে ফিরে পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন তিনি।
শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বগুড়া প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এসব বলেন সন্তানের মা তাজমিনা আক্তার। এ সময় আরেক জমজ সন্তান মেয়ে তাসনিয়া আক্তার (১০) তার সঙ্গে ছিলেন। তাজমিনা বগুড়ার গাবতলী উপজেলার শালুকগাড়ি এলাকার হেলাল উদ্দিনের স্ত্রী।
সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী মা তাজমিনা আক্তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, বগুড়া শহরের আইভি ক্লিনিকে গত ২০১৩ সালে ২৮ জুলাই ২টি জমজ সন্তান প্রসব করি। ক্লিনিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আমার ছেলে সন্তান চুরি করে গাবতলী উপজেলার ঈশ্বরপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেনের কাছে বিক্রি করা হয়। পরে নেপালতলী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আমি সেই হারানো সন্তানের খোঁজ পাই। তারপর আমি গ্রাম পুলিশ দিয়ে শালিসের ব্যবস্থা করি। সেখানে আমি আপস-মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। তারপর আমি ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ দেই। সেখানেও মীমাংসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এরপর চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় ২০১৯ সালে বগুড়া জজ কোর্ট নারী শিশু ট্রাইবুনাল-২ মামলা দায়ের করি। সেখানেও মীমাংসা করা সম্ভব হয়নি। পরে আদালত থেকে ডিএনএ টেস্টের আদেশ দেন। তারপর ডিএনএর নমুনা নিতে বগুড়া জেলা কারাগারে ২৫/০৩/২০১৯ তারিখে আমাকে পাঠানো হয়।
সেখান থেকে ২৭/০৩/২০১৯ তারিখে আমাকে ঢাকা কাশিমপুর কারাগারে চালান দেওয়া হয়েছিল। সেখানে ৭ দিন রাখার পর আমার ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়। সেই ডিএনএ টেস্টের ৩ মাস পর আমার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। রিপোর্ট সম্পর্কে আমার বগুড়ার আইনজীবী আদালতে নারাজি দিয়ে পুনরায় পরীক্ষার জন্য ২০ হাজার টাকা জমা নেন। এরপর আবার ডিএনএ পরীক্ষার তারিখ দিয়ে ০৯/০১/২০২২ তারিখে আমাকে কারাগারে নিয়ে ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। পরে অফিস থেকে আমি জানতে পারি প্রথম ডিএনএ রিপোর্ট পজিটিভ ছিল। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সন্তান নেওয়ার জন্য আদালতে ডিএনএ পজিটিভ রিপোর্ট দিয়ে পিটিশন দাখিল করি। সেখানে সন্তান না দিয়ে রিপোর্টসহ আমাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
তাজমিনা আক্তার আরও বলেন, ডিএনএ পজিটিভ থাকা সত্বেও আমাকে সন্তান না দেওয়ায় বগুড়া আদালত থেকে আদেশের কপি উত্তোলন করি। অবশেষে নিরুপায় হয়ে ১২/১২/২০২২ তারিখে সন্তান চেয়ে হাইকোর্টে এনেক্স-১৩ রিট মামলা করি। রিট মামলা শুনানি শেষে একই তারিখে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমদ সোহেল হাইকোর্টে বেঞ্চ আদেশ দেন। ১৪ ডিসেম্বরে ’ চুরি হওয়া সন্তান ফিরে পেতে রিট: মামলার নথি হাইকোর্টে তলব’’ শিরোনামে ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। তারপর ১৪/১২/২০২২ তারিখে মামলার নথি নিয়ে বগুড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারকে হাজিরার তারিখ হয়। বিচারক নথিতে নেগেটিভ রিপোর্ট দায়ের করে। পরে আমার হাইকোর্টের আইনজীবীরা ডিএনএ অফিস থেকে পজিটিভ রিপোর্ট সংগ্রহ করে। এরপর ১৫/১২/২২ তারিখে রিট শুনানি হয়। তারপর ০২/০১/২০২৩ তারিখে আদেশের তারিখ ধার্য হয়। সেই তারিখে ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবী তারিখ গোপন রাখেন। এরপর আইনজীবী ২৮/১২/২২ তারিখে রাত ৯টার দিকে তার নিজ বাসায় ফোনে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে অনেক ভয়ভীতি দেখায় এবং অকথ্য ভাষায় কথা বলে। তারপর আমার বগুড়া জজ কোর্টের আইনজীবীকে ফোনে হুমকি প্রদান করেন। উক্ত আইনজীবী আমাকে না জানিয়ে হাইকোর্টে দাখিলকৃত রিট মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। পরে ফোন করে আইনজীবী জানান আপনার মামলা বিচারক খারিজ করে দিয়েছেন। তখন আমি বলি আদেশের কপি দেন। তখন আইনজীবী বলেন, তিন মাস পর কপি পাবেন। পরে হাইকোর্টে গিয়ে জানতে পারি গোপনে রিট মামলাটি আমার আইনজীবী প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এই মামলায় মোট ৬টি জালিয়াতি করা হয়েছে। আল্ট্রাসনোগ্রাফি রিপোর্ট, প্রেস্ক্রিপশন, ডাবল স্ট্যাম্প, ডিএনএ রিপোর্ট, নথি থেকে অনেক পজিটিভ কাগজ ও রিট মামলা না জানিয়ে প্রত্যাহার করা। এই মামলার ৬টি জালিয়াতি করে আসামি জামিনে ঘোরাফেরা করছে আর আমি বাদী জেল হাজতে থাকি।
চুরি হওয়ার সন্তানের মা আরও বলেন, আমার জমজ সন্তানের মধ্যে মেয়ে সন্তানটি আমার কাছে বড় হচ্ছে। কিন্তু ছেলে সন্তানটি চুরি করে বিক্রি করায় আমার কাছে নেই। সেই ছেলে সন্তানকে ফিরে পেতে আবারও নতুন করে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী, বিচারপতি এবং এনেক্স-১৩ এর বিচারকের কাছে আমার আকুল আবেদন ন্যায় বিচার করে চুরি হওয়ার সন্তানকে আমার বুকে ফিরিয়ে দেবেন।